সাধারণত কাজ বলতে আমরা দৈনন্দিন কার্যক্রমকে বুঝি । তা হতে পারে কোন কাজ করা , খাওয়া , ঘুমানো , পড়াশোনা করা ইত্যাদি । এসব কাজ করার জন্য নিশ্চয়ই শক্তির প্রয়োজন হয়। আবার দেহের শক্তি বৃদ্ধির জন্য আমরা খাদ্য গ্রহণ করি। জৈবিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে মানব শরীর খাদ্য হতে শক্তি গ্রহণ করে এবং কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করে । কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে কাজ বলতে এ সব কিছুকেই বোঝায় না । এর একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে । পদার্থবিজ্ঞানে কাজের সাথে ফলাফল জড়িত। এক্ষেত্রে কাজ করার হার হচ্ছে ক্ষমতা । বল প্রয়োগ করলে কাজ সৃষ্টি হতে পারে আবার না ও হতে পারে ।। শক্তি হচ্ছে কাজ করার সক্ষমতা। মহাবিশ্বে শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংশ করা সম্ভব নয়। শক্তি শুধু এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরের মাধ্যমে আমরা ব্যবহার করে থাকি মাত্র । মহাবিশ্বের মোট শক্তির কোনো পরিবর্তন হয় না। সৃষ্টির শুরু থেকে যা ছিল এখন ও তাই আছে এবং ভবিষ্যতে ও তাই থাকবে ।
কাজ
আমরা দৈনন্দিন জীবনে কাজ শব্দটা অনেকভাবে ব্যবহার করি। একজন দারোয়ান গেটের সামনে একটি টুলে বসে সারা দিন বাসা পাহারা দিয়ে দাবি করতে পারেন তিনি অনেক কাজ করেছেন; কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় সেটি কোনো কাজ নয়। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় কাজ কথাটার সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। কোনো বস্তুর উপর যদি বল প্রয়োগ করে যেদিকে বল প্রয়োগ করা হচ্ছে,
সেদিকে বস্তুটিকে একটা দূরত্বে সরানো যায় তাহলে বলা হয় বলটি কাজ করেছে । আমরা বল প্রয়োগ বলতে কোনো কিছুকে ধাক্কা দেওয়া, টানা, ঠেলে দেওয়া, আকর্ষণ কিংবা বিকর্ষণ করাকে বোঝাই। অর্থাৎ যদি F বল প্রয়োগ করে বস্তুটিকে বলের দিকে S দূরত্ব অতিক্রম করানো হয়, তাহলে ঐ বল দিয়ে করা কাজের পরিমাণ w হচ্ছে: W = Fs.
যেখানে কাজের একক হচ্ছে জুল। কাজেই আমরা যদি কোনো কিছুর উপর বল প্রয়োগ করে বস্তুটিকে নাড়াতে না পারি তাহলে
আমাদের যত পরিশ্রমই হয়ে থাকুক না কেন কোনো কাজ হয়নি বলে ধরে নিতে হবে। ঠিক একইভাবে যদি যেদিকে বল প্রয়োগ করা হয়েছে, বস্তুটি সেদিকে না গিয়ে বলের সমকোণে সরে যায়,
তাহলে ধরে নিতে হবে তখনও কোনো কাজ করা হয়নি। বলের আকর্ষণে যখন কোনো বস্তু তাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘোরে তখন এই ব্যাপারটি ঘটে।
যার অর্থ সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবী যখন তাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘোরে কিংবা পৃথিবীর আকর্ষণে যখন চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘোরে তখন কোনো কাজ করা হয় না ।
তাহলে আমরা বলতে পারি কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগে যদি বস্তুটির সরণ ঘটে, তাহলে বল এবং বলের দিকে বলের প্রয়োগবিন্দুর সরণের উপাংশের গুণফলকে কাজ বলে ।
কাজ= বল × বলের দিকে সরণের উপাংশ
কাজের আন্তর্জাতিক একক (SI unit): জুল/ Joule ।
সি. জি. এস পদ্ধতিতে কাজের একক: আর্গ ।
১ জুল = আর্গ
‘একটি ডাস্টার টেবিলের উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেল' কি ধরনের কাজ হয়: বলের দ্বারা কাজ । কারণ ডাস্টারটি অভিকর্ষ বলের দিকে নিচে পড়ল ।
একটি ডাস্টার যদি মেঝে থেকে টেবিলের উপর উঠানো হল' কি ধরনের কাজ হয়: বলের বিরুদ্ধে কাজ। কারণ এই ক্ষেত্রে অভিকর্ষ বল যে দিকে ক্রিয়া করে, সরণ তার বিপরীত দিকে হল ।
পাহাড়ে উঠায় বা সিঁড়ি ভাঙ্গায় পরিশ্রম বেশি হয়, কারণ অভিকর্ষ বলের বিপরীতে কাজ করতে হয় বলে।
ক্ষমতা
বিজ্ঞানের ভাষায় ক্ষমতা হচ্ছে কাজ করার হার। অথবা একক সময়ে ব্যক্তি বা উৎসটি দ্বারা সম্পাদিত কাজের পরিমাণই হচ্ছে ক্ষমতা । অর্থাৎ t সময়ে w কাজ করা হয়ে থাকলে ক্ষমতা P হচ্ছে:
P =
আমরা আগেই দেখেছি, কাজ করার অর্থ হচ্ছে শক্তির রূপান্তর। শক্তির যেহেতু ধ্বংস নেই, তাই কাজ করার মধ্যে দিয়ে শক্তির রূপান্তর করা হয় মাত্র। তাই ইচ্ছে করলে আমরা বলতে পারি, ক্ষমতা হচ্ছে শক্তির রূপান্তরের হার। শক্তিকে তার একটি রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত করার বেলায় সব সময়ই খানিকটা শক্তির অপচয় হয়। কাজেই সব সময়ই আমরা যে পরিমাণ কাজ করতে চাই, তার সমপরিমাণ শক্তি দিলে হয় না, একটু বেশি শক্তি দিতে হয়।
শক্তির এককটি আমাদের খুব পরিচিত না হলেও ক্ষমতার এককটি আমাদের বেশ পরিচিত। যদি প্রতি সেকেন্ডে 1 জুল কাজ করা হয়, তাহলে আমরা বলি 1 ওয়াট (W ) কাজ করা হয়েছে বা শক্তির রূপান্তর হয়েছে।
আমরা যদি 100 W এর একটা বাতি জ্বালাই তার অর্থ এই বাতিতে প্রতি সেকেন্ডে 100 জুল শক্তি ব্যয় হচ্ছে। নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র 1000 MW বিদ্যুৎ তৈরি হবে,
সেই কথাটির অর্থ এই নিউক্লিয়ার শক্তিকেন্দ্রে প্রতি সেকেন্ডে 1000 × জুল বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হবে।
ইঞ্জিনের ক্ষমতাকে প্রকাশ করার জন্য অশ্বক্ষমতা বা হর্স পাওয়ার (Horse power) একক ব্যবহৃত হয়।
1 হর্স পাওয়ার = ৭৪৬ ওয়াট = ৫৫০ ফুট-পাউন্ড/সেকেন্ড
শক্তি
শক্তি বলতে কী বোঝায় আমাদের সবার মধ্যে তার একটা ভাসাভাসা ধারণা আছে, কারণ আমরা কথাবার্তায় বিদ্যুৎশক্তি, তাপশক্তির কথা বলে থাকি। মধ্যে মধ্যে আমরা রাসায়নিক শক্তি বা নিউক্লিয়ার শক্তির কথাও শুনে থাকি। আলোকে শক্তি হিসেবে সেভাবে বলা না হলেও আমরা অনুমান করতে পারি, আলোও হচ্ছে এক ধরনের শক্তি। দৈনন্দিন কথাবার্তায় যে শক্তিটার কথা খুব বেশি বলা হয় না, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে অসংখ্যবার যে শক্তির কথা বলা হবে সেটা হচ্ছে গতিশক্তি! কাজেই আমাদের ধারণা হতে পারে প্রকৃতিতে বুঝি অনেক ধরনের শক্তি আছে, কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সব শক্তিই কিন্তু এক এবং আমরা শুধু এক ধরনের শক্তিকে অন্য ধরনের শক্তিতে রূপান্তর করি! তাহলে শক্তিটা কী?
শক্তি হচ্ছে কাজ করার ক্ষমতা! শুধু তা-ই না, যখন কোনো বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করে কাজ করা হয়, তখন সেই বলটি আসলে বস্তুটির মধ্যে একটা শক্তি দিয়ে দেয়। তাই বস্তুটির মধ্যে যতটুকু কাজ করা হয়েছে, বস্তুটির মধ্যে ঠিক ততটুকু শক্তি সৃষ্টি হয় এবং যে বল প্রয়োগ করছে তার ঠিক সেই পরিমাণ শক্তি খরচ হয়ে যায়। সেজন্য শক্তির এককও কাজের এককের সমান, জুল। কাজেই একটা বস্তুকে বল প্রয়োগ করে খানিকটা দূরত্বে ঠেলে নেওয়ার পর তার ভেতর কখনো গতির কারণে গতিশক্তি তৈরি হয়, কখনো ঘর্ষণের কারণে তাপশক্তি সৃষ্টি হয়, কখনো অবস্থানের কারণে স্থিতি শক্তির সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ যেটুকু কাজ করা হয়েছে সেটি কখনো নষ্ট হয় না, কোনো না কোনোভাবে এক ধরনের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবী যখন তাকে ঘিরে বৃত্তাকারে ঘোরে তখন যেহেতু কোনো কাজ করা হয় না, তাই সেখানে সূর্যের কোনো শক্তি খরচ হয় না, পৃথিবীরও কোনোও শক্তি বৃদ্ধি হয় না।
সুতরাং আমরা বলতে পারি , কোন বস্তুর কাজ করার সামর্থ্যকে শক্তি বলে । শক্তির একক ও কাজের একক একই অর্থাৎ জুল ।
প্রকৃতিতে আমরা শক্তির নয়টি রূপ পর্যবেক্ষণ করি -
১. যান্ত্রিক শক্তি
২. তাপ শক্তি
৩. শব্দ শক্তি
৪. আলোক শক্তি
৭. রাসায়নিক শক্তি
৫. চৌম্বক শক্তি
৮. নিউক্লিয় শক্তি
৬. বিদ্যুৎ শক্তি
৯. সৌর শক্তি ।
শক্তির সবচেয়ে সাধারণ রূপ হচ্ছে যান্ত্রিক শক্তি, বস্তুর অবস্থান, আকার এবং গতির কারণে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকেই যান্ত্রিক শক্তি বলে। যান্ত্রিক শক্তির দুটি রূপ হতে পারে গতিশক্তি এবং স্থিতিশক্তি।
ক) বিভব শক্তি বা স্থিতিশক্তি: বস্তুকে অন্য কোন অবস্থান বা অবস্থায় আনলে বস্তু কাজ করার যে সামর্থ্য অর্জন করে তাকে বিভব শক্তি বা স্থিতিশক্তি বলে। ঘড়িতে দম দেওয়ায় স্থিতিশক্তি শক্তি
সঞ্চিত হয়।
বিভব শক্তি = বস্তুর ওজন × উচ্চতা
খ) গতি শক্তি: কোন গতিশীল বস্তু তার গতির জন্য কাজ করার যে সামর্থ্য লাভ করে. তাকে গতিশক্তি বলে।
বস্তুর গতি শক্তি = × ভর ×
শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি
আমরা আমাদের চারপাশে যে শক্তি দেখি, সেটি অবিনশ্বর। এর কোনো ক্ষয় নেই, এটি শুধু একটি রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন হয়। একটা পাথর উপরে তুললে তার মধ্যে স্থিতিশক্তি বা বিভব শক্তির জন্ম হয়। পাথরটা ছেড়ে দিলে বিভব বা স্থিতিশক্তি কমতে থাকে এবং গতিশক্তি বাড়তে থাকে। মাটি স্পর্শ করার পূর্বমুহূর্তে পুরো শক্তিটাই গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু মাটিকে স্পর্শ করার পর পাথরটি যখন থেমে যায়, তখন তার ভেতরে গতিশক্তিও থাকে না বিভবশক্তিও থাকে না, তাহলে শক্তিটা কোথায় যায়? তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, পাথরটা যখন মেঝেতে আঘাত করে তখন সেটি শব্দ করে যেখানে আঘাত করেছে সেখানে তাপের সৃষ্টি করে অর্থাৎ গতিশক্তিটুকু শব্দ কিংবা তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
একটি ছোট পাথরকে সুতা দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে যদি আমরা এক পাশে একটু টেনে নিই, তাহলে সেটি তার স্থির অবস্থা থেকে একটু উপরে উঠে যায় বলে তার ভেতর এক ধরনের স্থিতিশক্তির জন্ম হয়। এখন পাথরটা ছেড়ে দিলে তার মধ্যে গতির সঞ্চার হয়। ঠিক মাঝখানে যখন পৌঁছায়, তখন স্থিতিশক্তির পুরোটাই গতিশক্তিতে রূপান্ত্রিত হয় এবং সে থেমে না গিয়ে অন্যদিকে যেতে থাকে এবং বেগ নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত উপরে উঠতে থাকে, অর্থাৎ তার ভেতরে আবার স্থিতিশক্তির জন্ম হয়। সবচেয়ে উঁচুতে পৌঁছে গিয়ে এটি থেমে যায়, তখন আবার তার ভেতরে উল্টো দিকে গতির সঞ্চার হতে থাকে। এভাবে পাথরটি দুলতে থাকে এবং তার শক্তি স্থিতিশক্তি থেকে গতিশক্তি এবং গতিশক্তি থেকে স্থিতিশক্তির মধ্যে রূপান্তর হতেই থাকে। ঘর্ষণ এবং অন্যান্য কারণে শক্তি ক্ষয় না হলে এই প্রক্রিয়াটি অনন্তকাল ধরে চলতে থাকত!
কাজেই শক্তির রূপান্তর খুবই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। শুধু বিভবশক্তি এবং গতিশক্তির মধ্যে যে রূপান্তর হতে পারে তা নয়। আমাদের পরিচিত সব শক্তিই এক রূপ থেকে অন্য রূপে যেতে পারে। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চারপাশে যে শক্তি দেখি, সেটি সৃষ্টিও হয় না ধ্বংসও হয় না, শুধু তার রূপ পরিবর্তন করে। এটাই হচ্ছে শক্তির নিত্যতার সূত্র বা শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতি । এক কথায় শক্তির সৃষ্টি বা বিনাশ নেই, শক্তি কেবল একরূপ থেকে অপর এক বা একাধিক রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়।
কর্মদক্ষতা
ইঞ্জিনে যতটুকু শক্তি পাওয়া যায় তাকে কার্যকর শক্তি বলে। কোন যন্ত্রের কর্মদক্ষতা বলতে যন্ত্র থেকে মোট যে কার্যকর শক্তি পাওয়া যায় এবং মোট যে শক্তি দেওয়া হয়েছে তার অনুপাতকে বুঝায়। কর্মদক্ষতাকে সাধারণত η (গ্রীক-ইটা) দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কর্মদক্ষতাকে সাধারণ শতকরা হিসাবে প্রকাশ করা হয়ে থাকে ।
কোন যন্ত্রের কর্মদক্ষতা 90% বলতে বুঝায়: এই যন্ত্রে 100J শক্তি দেওয়া হলে যন্ত্র থেকে 90J কার্যকর শক্তি পাওয়া হবে।
কোন যন্ত্রের 20% শক্তি নষ্ট হলে কর্মদক্ষতা কত: 8০%
সর্বাপেক্ষা বেশি দক্ষতাসম্পন্ন ইঞ্জিন: বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন ।