জৈব যৌগ

জৈব যৌগ মূলত কার্বন যৌগ। জৈব যৌগে কার্বনের সাথে এক বা একাধিক বিভিন্ন মৌল যুক্ত থাকে। জীব ও প্রাণিদেহ মূলত জৈব যৌগের সমন্বয়ে গঠিত। পৃথিবীতে জৈব যৌগের সংখ্যা ৮০ লক্ষের অধিক । কার্বনের যৌগসমূহ তথা জৈব যৌগের প্রস্তুতি, ধর্ম, গঠন, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয় জৈব রসায়নে। জৈব রসায়ন শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন জন্স জ্যাকব বার্জেলিয়াস ১৮১৫ সালে । জৈব কথাটির উৎপত্তি হয় প্রথম শতাব্দীতে। তিনি রসায়নকে দুটি শাখায় বিভক্ত করেন: জৈব রসায়ন এবং অজৈব রসায়ন । তবে ফ্রেডরিখ ওহলারকে জৈব রসায়নের জনক বলা হয় কারণ ১৮২৮ সালে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বহু সংখ্যক উপাদানকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। তিনি একজন জার্মান রসায়নবিদ ছিলেন । এই জৈব রসায়নের চারটি প্রধান উপাদান হল হাইড্রোজেন, কার্বন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন । কাজেই জৈব রসায়ন সম্পর্কে আমাদের ভালভাবে বুঝতে হলে এই চারটি উপাদান সম্পর্কে আমাদের স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে । পৃথিবীতে পরীক্ষাগারে কৃত্রিমভাবে প্রথম জৈব যৌগ হিসাবে ইউরিয়া প্রস্তুত করা হয়েছিল। ফ্রেডরিখ ওহলার অ্যামোনিয়াম সায়ানেট থেকে এটি সংশ্লেষ করেছিলেন। যদি ও ইউরিয়া এখন তরল অ্যামোনিয়া এবং তরল কার্বন-ডাই-অক্সাইড থেকে প্রস্তুত করা হয়।

জৈব যৌগ

জৈব যৌগ

জৈব যৌগ: কার্বন ও হাইড্রোজেন দ্বারা গঠিত যৌগসমূহকে হাইড্রোকার্বন বলে। এই হাইড্রোকার্বন ও হাইড্রোকার্বন সৃষ্ট যৌগসমূহকে জৈব যৌগ বলে ৷ উদাহরণ: মিথেন (CH4), ইথেন (C2H2), মিথাইল অ্যালকোহল (CH3OH)

জৈব রসায়নের জনক: ফ্রেডারিক উহলার (Friedrich Wohler) . তিনি জার্মান বিজ্ঞানী । ১৮২৮ সালে তিনি অ্যামোনিয়াম সালফেট কে উত্তপ্ত করে পরবর্তী ইউরিয়া সার প্রস্তুত করেন যা একটি জৈব যৌগ। ।

ক্যাটেনেশন: একই মৌলের পরমাণুসমূহের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের শিকল গঠনের ধর্মকে ক্যাটেনেশন বলা হয় ।
কার্বনের যে ধর্মের জন্য এত অধিক সংখ্যক যৌগ সম্ভব হয়েছে: ক্যাটেনেশন।
কার্বন ছাড়া আর কোন মৌলের ক্যাটেনেশন ধর্ম দেখা যায়: সিলিকন, সালফার।

কার্বনের ক্যাটেনেশন

জৈব যৌগ ও অজৈব যৌগের পার্থক্য

জৈব যৌগ অজৈব যৌগ
১) মূলত কার্বন দ্বারা গঠিত। তবে এর সাথে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, হ্যালোজেন প্রভৃতি মৌল থাকে । ১) অজৈব যৌগ যে কোন মৌল দ্বারা গঠিত হতে পারে।
২) জৈব যৌগ সমযোজী বন্ধন দ্বারা গঠিত হয় । ২) সাধারণ আয়নিক বন্ধন দ্বারা গঠিত হয়।
৩) বিক্রিয়ার গতি ধীর গতিসম্পন্ন ৩) বিক্রিয়ার গতি দ্রুত গতিসম্পন্ন
৪) নিম্ন গলনাংক ৪) উচ্চ গলনাংক
৫) সহজেই বাষ্পনীয় ৫) বাষ্পনীয় নয়
৬) গঠন জটিল ৬) গঠন জটিল

জৈব যৌগে যে মৌলটি অবশ্যই থাকবে: কার্বন।
জৈব যৌগে কার্বন ছাড়া আর যে মৌল থাকতে পারে: হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হ্যালোজেন, সালফার, ফসফরাস ইত্যাদি ।
কোন জৈব বস্তুর সম্পূর্ণ দহনের ফলে যে গ্যাস উৎপন্ন হয়: কার্বন ডাই আক্সাইড
কোন জৈব বস্তুর অসম্পূর্ণ দহনের ফলে যে গ্যাস উৎপন্ন হয়: কার্বন মনোক্সাইড ।

কার্যকরীমূলক

কার্যকরীমূলক: যে পরমাণু বা মূলক কোন জৈব যৌগের অণুতে বিদ্যমান থেকে কার্যত তার ধর্ম ও বিক্রিয়া নির্ধারণ করে, তাকে ঐ যৌগের কার্যকরীমূলক বলে । কার্যকরী মূলকের নাম থেকেই জৈব যৌগের অণুগুলির নামকরণ করা হয়ে থাকে।

অ্যালকোহল, অ্যালডিহাইড, কিটোন, কার্বক্সিলিক এসিডের কার্যকরীমূলক:

সমগোত্রীয় শ্রেণীর নাম কার্যকরীমূলক
অ্যালকোহল -OH
অ্যালডিহাইড -CHO
কিটোন -CO-
কার্বক্সিলিক এসিড -COOH

জৈব যৌগের প্রকারভেদ

কার্বন শিকলের প্রকৃতি অনুযায়ী জৈব যৌগসমূহকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়: ১. অ্যালিফেটিক যৌগ এবং ২. অ্যারোমেটিক যৌগ ।

অ্যালিফেটিক যৌগ: যে সকল জৈব যৌগের অণুতে কার্বন পরমাণুসমূহের মুক্ত শিকল বিদ্যমান, তাদেরকে অ্যালিফেটিক যৌগ বলে। যেমন; মিথেন (CH4), ইথেন (CH3-CH3), প্রোপেন (CH3-CH2-CH3) ইত্যাদি।

হাইড্রোকার্বন: হাইড্রোজেন ও কার্বন দ্বারা গঠিত দ্বি-মৌল যৌগসমূহকে হাইড্রোকার্বন বলে। হাইড্রোকার্বন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন অ্যালকেন, অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন অ্যালকিন ও অ্যালকাইন, ও অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বন।

সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন: যেসব হাইড্রোকার্বনের কার্বন পরমাণুর গুলো পরস্পর একক বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে ও কার্বনের অবশিষ্ট বন্ধনগুলো একযোজী হাইড্রোকার্বন দ্বারা পূর্ণ হয় তাদেরকে সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন বা সম্পৃক্ত যৌগ বলা হয় ।

অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন: যেসব হাইড্রোকার্বনে কমপক্ষে একটি কার্বন— কার্বন দ্বি-বন্ধন বা ত্রি-বন্ধন থাকে এবং কার্বনের অবশিষ্ট বন্ধনগুলো একযোজী হাইড্রোজেন দ্বারা পূর্ণ হয় তাদেরকে অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন বা অসম্পৃক্ত জৈব যৌগ বলা হয় ।

অ্যালিফেটিক হাইড্রোকার্বন যৌগসমূহকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা—

ক) অ্যালকেন: হাইড্রোজেন ও কার্বন পরমাণু দ্বারা গঠিত একক বন্ধনে আবদ্ধ যৌগসমূহকে অ্যালকেন বলে। অ্যালকেনের সাধারণ সংকেত CnH2n + 1। যেমন- মিথেন (CH4), ইথেন (CH3-CH3), প্রোপেন (CH3-CH2- CH3) ইত্যাদি।
খ) অ্যালকিন: হাইড্রোজেন ও কার্বন পরমাণু দ্বারা গঠিত দ্বি বন্ধনে আবদ্ধ যৌগসমূহকে অ্যালকিন বলে । অ্যালকেনসমূহের সাধারণ সংকেত CnH2n। যেমন- ইথিন (CH2 = (CH2 , প্রোপিন (CH2 = CH-CH3) ইত্যাদি।
গ) অ্যালকাইন: হাইড্রোজেন ও কার্বন পরমাণু দ্বারা গঠিত ত্রি বন্ধনে আবদ্ধ যৌগসমূহকে অ্যালকাইন বলে। অ্যালকাইনসমূহের সাধারণ সংকেত CnH2n - 2 । যেমন- ইথাইন (CH CH), প্রোপাইন (CH C-CH3) ইত্যাদি।

প্যারাফিন: ‘প্যারাফিন' একটি ল্যাটিন শব্দ । এর অর্থ ‘আকর্ষণ নেই’। অ্যালকেনসমূহের নিষ্ক্রিয়তার জন্য এদেরকে প্যারাফিন বলে ।

মিথেন (CH4)

মিথেন হচ্ছে একটি রাসায়নিক যৌগ যার রাসায়নিক সংকেত (CH4) । এর প্রতিটি অনুতে আছে এক পরমাণু কার্বন ও চার পরমাণু হাইড্রোজেন। এটি একটি অ্যালকেন এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উপাদান।

আলেয়া: অন্ধকার রাতে ডোবা-নালার পচা জলাভূমিতে আলো জ্বলতে দেখা যায়, এটাই আলেয়া। বদ্ধ জলাভূমিতে গাছপালা পচনের ফলে মিথেন উৎপন্ন হয়। এ গ্যাসটি মার্শ গ্যাস নামে পরিচিত । জলাভূমিতে যে মিথেন উৎপন্ন হয় তার সাথে প্রাণীদেহের বিয়োজনের ফলে উৎপন্ন দাহ্য ফসফিন [PH3] এবং ডাইফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড [P2H4] মিশে থাকে। ডাইফসফরাস টেট্রাহাইড্রাইড [P2H4] বায়ুতে দহনের ফলে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা মিথেনকে লীলাভ শিখায় জ্বলতে সাহায্য করে। এই বিচরণশীল আলোক শিখাই হল আলেয়া (Will-O- the wisp) । আলেয়া কোনো ভৌতিক ঘটনা নয়, এটি একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা ।

ইউরিয়া সারের কাঁচামাল মিথেন গ্যাস। ইউরিয়া একটি নাইট্রোজেন ঘটিত জৈব যৌগ। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস মিথেন থেকে ইউরিয়া সার তিন ধাপে উৎপাদন করা হয়। নাইট্রোজেন গ্যাসকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়ায় রূপান্তরিত করা হয় এবং পরে অ্যামোনিয়া থেকে ইউরিয়া প্রস্তুত করা হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে H2 ও CO2 গ্যাস উৎপাদন, N2 ও H2 থেকে NH3 উৎপাদন ও NH3 গ্যাস ও CO2 হতে ইউরিয়া উৎপাদন করা হয়। ইউরিয়ায় নাইট্রোজেনের পরিমাণ ৪৬%। এ সার গাছকে সবুজ ও সতেজ করে। ইউরিয়া একটি অম্লধর্মী সার।

ক্লোরোফর্ম ও ‍ টিয়ার গ্যাস

ক্লোরোফর্ম একটি জৈব যৌগ এবং এটির রাসায়নিক নাম ট্রাই ক্লোরোমিথেন CHCl3 । ক্লোরোফর্ম একটি হ্যালোমিথেন যা চারটি ক্লোরোমিথেন এর একটি। এটি বর্ণহীন, মিষ্টি গন্ধযুক্ত, ঘন তরল যা বিষাক্ত বলে গণ্য। আলোর উপস্থিতিতে এটি বায়ুর অক্সিজেন দ্বারা জারিত হয়ে ধীরে ধীরে কার্বনিল ক্লোরাইড নামে এক ধরনের বিষাক্ত ফসজিন গ্যাসে পরিণত হয়। তাই একে বাদামি বর্ণের বোতলের মধ্যে রাখা হয় । টিয়ার গ্যাস বা কাঁদুনে গ্যাস এর অন্য নাম ( ক্লোরোপিক্রিন বা নাইট্রোক্লোরোফরম ) যা কয়েক ধরনের রাসায়নিক যৌগের একীভূত নামকরণ। প্রকৃতপক্ষে এটি কোন গ্যাস নয়। মিহি গুড়ো পাউডার কিংবা তরলের অতি ক্ষুদ্রকণার সমষ্টি নিয়ে এ গ্যাস গঠিত। গুড়োয় ক্ষারজাতীয় রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে।

ক্লোরোফর্মের ব্যবহারঃ
১. অস্ত্রোপাচারে চেতনানাশক হিসেবে।
২. পচন নিবারণের কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
৩. দ্রাবক ও বিকারকরূপে ব্যবহৃত হয়।
৪. পলিটেট্রাফ্ল‌ুরোইথিলিন ( PTFE ) এর কাঁচামাল এবং হিমায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

কাঁদুনে গ্যাস বা টিয়ার গ্যাস:
কাঁদুনে গ্যাসের রাসায়নিক নাম: ক্লোরোপিক্রিন বা নাইট্রোক্লোরোফরম (Cl3 C-NO2)।
ক্লোরোফর্মের সাথে গাঢ় নাইট্রিক এসিডের বিক্রিয়ায় কাঁদুনে গ্যাস উৎপন্ন হয়।
CHCl3 + HNO3 (গাঢ়) = Cl3CNO2 (কাঁদানে গ্যাস) + H2O
এটি তৈল জাতীয় পদার্থ এবং অশ্রু উৎপাদক গ্যাস।

ইথিলিন , পলিথিন ও মাস্টার্ড গ্যাস

ইথিলিন বা ইথিন (CH2 = CH2) : ইথিলিনে কার্বন শিকলে পাশাপাশি দুই কার্বন পরমাণু দ্বিবন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে । কৃত্রিম উপায়ে ফল পাকাতে ইথিলিন গ্যাস ব্যবহৃত হয় ।

মাস্টার্ড গ্যাস:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই গ্যাসটি ব্যবহৃত হয়েছিল ।
মাস্টার্ড গ্যাস একটি বিষাক্ত গ্যাস। এর রাসায়নিক সংকেত হল Cl-CH2-S-CH2-Cl
ইথিলিনের সাথে সালফার ক্লোরাইডের বিক্রিয়ায় এ গ্যাস উৎপন্ন হয়। CH2 = CH2 + S2Cl2 → C1-CH2-S-CH2 - Cl + S

পলিথিন :
ইথিলিনের পলিমার ।
উচ্চচাপ (1000-1200 atm) ও তাপমাত্রা 200°C এ অতি সামান্য পরিমাণ অক্সিজেনের উপস্থিতিতে তরলীভূত ইথিলিনের অসংখ্য অণু পরস্পর যুক্ত হয়ে পলিইথিন বা পলিথিন নামক প্লাস্টিকে পরিণত হয়।
n(CH2 = CH2) → (-CH2-CH2-)n
পলিভিনাইল ক্লোরাইড পোড়ালে যা উৎপন্ন হয়: হাইড্রোক্লোরিক এসিড ।
কন্ট্রাক্ট লেন্স তৈরি করা হয় ‘পলিভিনাইল ক্লোরাইড' নামক পলিমার দ্বারা ।
শতাধিক পরমাণু বিশিষ্ট অণুর উদাহরণ: প্লাস্টিক।

অ্যাসিটিলিন (C2H2 )

ইথাইন যার আরেকটি নাম অ্যাসিটিলিন একটি অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন। এর গাঠনিক সংকেতে হাইড্রোকার্বনের কার্বন শিকলে পাশাপাশি দুই কার্বন পরমাণু ত্রিবন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে । । ত্রিবন্ধনের একটি সিগমা ও দুটি পাই বন্ধন। কার্বন কার্বন বন্ধনের দৈর্ঘ্য ০.১২১ ন্যানোমিটার এটি সাধারণ অবস্থায় গাস/তরল।

ঝালাইয়ের কাজে যে শিখা ব্যবহৃত হয়: অক্সিহাইড্রোজেন শিখা এবং অক্সি-এসিটিলিন শিখা ।
অক্সি হাইড্রোজেন শিখা: এটি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন এর মিশ্রণে তৈরি। এই শিখা হতে প্রায় ২৮০০°C তাপমাত্রা পাওয়া যায়।
অক্সি এসিটিলিন শিখা: ধাতব নলের সরুমুখে এসিটিলিন গ্যাসকে প্রচুর বায়ু বা অক্সিজেনে প্রজ্জ্বলিত করলে এসিটিলিনের পূর্ণ দহনের ফলে নীলাভ শিখা উৎপন্ন হয়। এই শিখা হতে প্রায় ৩০০০- ৩৫০০° C তাপমাত্রা পাওয়া যায়।

অ্যালকোহল

রসায়নে অ্যালকোহল (Alcohol) বলতে এমন সব জৈব যৌগকে বোঝায় যাদের হাইড্রক্সিল কার্যকারী গ্রুপটি একটি অ্যালকাইল বা অ্যারাইল গ্রুপের কার্বনের সাথে একটি বন্ধনের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। অ্যালকোহল শব্দটি আরবি শব্দ "আল-কুহ" থেকে এসেছে যার অর্থ সাধারণভাবে ইথানল। ইথানল বর্ণহীন একধরনের উদ্বায়ী তরল যা গাঁজনের মাধ্যমে আখ থেকে তৈরি করা যায়।

ফারমেন্টেশন বা চোলাইকরণ বা গাঁজন : জটিল জৈব যৌগকে এনজাইমের প্রভাবে আর্দ্রবিশ্লেষিত করে অপেক্ষাকৃত সরল অণুবিশিষ্ট পদার্থে পরিণত করাকে বলা হয় ফারমেন্টেশন বা গাঁজন ।

গুকোজের ফারমেন্টেশনে যা উৎপন্ন হয়: অ্যালকোহল ৷
C6H12O6 → 2C2H5OH + 2CO2

ফারমেন্টেশনে ঈস্টের ভূমিকা : ঈস্ট থেকে নিঃসৃত জাইমেস এনজাইম ফারমেন্টেশনে প্রভাবকের কাজ করে ।

ইনভার্ট সুগার: গুকোজ ও ফ্রুক্টোজের সমআণবিক মিশ্রণ ।

গুকোজ ফেইলিং দ্রবণকে বিজারিত করলে লাল বর্ণের Cu2O-এর অধঃক্ষেপ পড়ে। কিন্তু গ্রুক্টোজ অবিজারক কিটো গ্রুপ যুক্ত হওয়ায় তা ফেহলিং দ্রবণকে বিজারিত করতে পারে না । আবার গুকোজ টলেন বিকারকের সাথে বিক্রিয়ায় সিলভার দর্পণ সৃষ্টি করে। কিন্তু ফুক্টোজ তা করে না। সুতরাং টলেন বিকারক ও ফেহলিং দ্রবণ দ্বারা এদেরকে আলাদা করা যায়।

যেসব শর্করা ফেহলিং দ্রবণ ও টলেন বিকারককে বিজারিত করতে পারে তাদেরকে বিজারক চিনি (Reducing Sugar) বলে। যেমন— গুকোজ, ফুক্টোজ, ম্যালটোজ ইত্যাদি। আর যারা এ টলেন বিকারক বা ফেইলিং দ্রবণকে বিজারিত করতে পারে না তাকে অবিজারক চিনি বলে। যেমন— সুক্রোজ অবিজারক চিনি ।

কোমল পানীয়তে সবচেয়ে দ্রবীভূত অবস্থায় কার্বন সমৃদ্ধ পানি, মিষ্টিজাতীয় পদার্থসহ সুগন্ধযুক্ত পদার্থের উপাদান বিদ্যামান থাকে ।

উড স্পিরিট: মিথাইল অ্যালকোহল ।
‘উড স্পিরিট’ যে কাজে ব্যবহৃত হয়: রং, বার্ণিশ করার কাজে ৷
রেকটিফাইড স্পিরিট: ৯৫.৬% ইথাইল অ্যালকোহল ও ৪.৪% পানির সমস্ফুটন মিশ্রণ ।
ইথাইল অ্যালকোহলের আইসোমার: ডাই মিথাইল ইথার ।

ইথাইল অ্যালকোহল:
বাজারে প্রাপ্ত মদের রাসায়নিক নাম: ইথাইল অ্যালকোহল ।
ইথানলকে মদ হিসেবে পানের অযোগ্য করার জন্য ইথানলের সাথে বিষাক্ত মিথানল মিশিয়ে বাজারে বিক্রি হয় ।

মেথিলেটেড স্পিরিট: ইথাইল অ্যালকোহলকে পানের অযোগ্য করার জন্য এর সাথে ৫-১০% মিথাইল অ্যালকোহল এবং দুগন্ধযুক্ত রঙিন পিরিডিনসহ ৩% বেনজিন মিশিয়ে বিক্রি করা হয় । ইথাইল অ্যালকোহলের এই মিশ্রণকে অসেবনীয় অ্যালকোহল বা মেথিলেটেড স্পিরিট বলে ।

‘মেথিলেটেড স্পিরিট” যে কাজে ব্যবহৃত হয়: রং, বার্ণিশ প্রস্তুতির কাজে দ্রাবকরূপে এবং স্পিরিট ল্যাম্পে জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত হয়।

বাজারে প্রাপ্ত বিভিন্ন পানীয়তে ইথাইল অ্যালকোহলের পরিমানঃ
হুস্কি, ব্রান্ডি, র‍্যাম, জিনঃ ৪০-৫০% ইথাইল অ্যালকোহল
দ্বিতীয় শ্রেণীর পানীয়ঃ ১২-২০% ইথাইল অ্যালকোহল
কোমল পানীয় - বিয়ার, সিডারঃ ৩ -৬% ইথাইল অ্যালকোহল

পাওয়ার অ্যালকোহল: ২০%-৩০% অ্যালকাহল + পেট্রোল + তৃতীয় কোন দাহ্য পদার্থ যেমন- ইথার, বেনজিন ইত্যাদির মিশ্রণ ।

পাওয়ার অ্যালকোহল যে কাজে লাগে: মোটরগাড়ির জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত হয় ।

এস্টার

জৈব অ্যাসিডের কার্বক্সিল গ্রুপের হাইড্রোজেন পরমাণু অ্যালকিল গ্রুপ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হলে যে যৌগ উৎপন্ন হয় তাকে এস্টার বলে। এস্টারের সাধারণ আণবিক সংকেত CnH2nO2 । এস্টারের কার্যকারী মূলক হল -COOR । সাধারণভাবে এই মূলককে কার্বোঅ্যালকক্সি মূলক বলে।

এস্টারকরণ: অজৈব এসিডের উপস্থিতিতে অ্যালকোহল জৈব কার্বক্সিলিক এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে এস্টার ও পানি উৎপন্ন করে। এ বিক্রিয়াকে এস্টারকরণ বলে।
অ্যালকোহল + কার্বক্সিলিক এসিড ⇆ এস্টার + পানি

ফুল ও ফলের মিষ্টি গন্ধের জন্য যা দায়ী: এস্টারই ফুল ও ফলের মিষ্টি গন্ধের জন্য দায়ী। পাকা কলায় অ্যামাইল অ্যাসিটেট নামক এস্টার থাকে। অজৈব এসিডের উপস্থিতিতে অ্যালকোহল জৈব কার্বলিক এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে এস্টার ও পানি উৎপন্ন হয় ।

ফল এস্টার
পাকা কলা অ্যামাইল অ্যাসিটেট
পাকা আনারস ইথাইল বিউটারেট
পাকা কমলা অকটাইল অ্যাসিটেট
নাশপাতি ৩ মিথাইল বিউটাইল ইথানয়েট

ফরমালডিহাইড বা মিথান্যাল (H-CHO) :
মিথানলকে বায়ুর অক্সিজেনের সাথে উচ্চ তাপমাত্রায় চালনা করলে মিথানল আংশিক জারিত হয়ে মিথান্যালে বা ফরমালডিহাইডে পরিণত হয় ।
ফরমালডিহাইড সাধারণত আয়োডোফর্ম বিক্রিয়া দেয় না ।
ফরমালডিহাইডের ৪০% জলীয় দ্রবণকে ফরমালিন বলে ।
ফরমালিন একটি কার্যকরী জীবাণুনাশক। এটি জীবদেহ সংরক্ষণ ও পচন নিবারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

হ্যালোফর্ম বিক্রিয়া: গাঢ় কস্টিক সোডা (NaOH) এর উপস্থিতিতে হ্যালোজেন মৌল (যেমন- ক্লোরিন, ব্রোমিন, আয়োডিন) CH3-COO- মূলকবিশিষ্ট কার্বনাইল যৌগ (যেমন- ইথাইল অ্যালকোহল, অ্যাসিটালডিহাইড, অ্যাসিটোন প্রভৃতি) এর সাথে বিক্রিয়া করে হ্যালোফরম (যেমন- ক্লোরোফরম, ব্রোমোফরম বা আয়োডোফরম) উৎপন্ন করে। এই বিক্রিয়াকে হ্যালোফরম বিক্রিয়া বলে। CH3-COO- মূলক থাকে না বলে মিথাইল অ্যালকোহল (CH3OH), ফরমালডিহাইড (H-CHO) প্রভৃতি হ্যালোফরম বিক্রিয়া দেয় না।

এসিড

অম্ল বা এসিড হচ্ছে একটি রাসায়নিক পদার্থ। যৌগের অণুতে এক বা একাধিক প্রতিস্থাপনীয় হাইড্রোজেন পরমাণু থাকে এবং ঐ প্রতিস্থাপনীয় হাইড্রোজেনকে ধাতু বা যৌগমূলক দ্বারা আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপিত করা যায় এবং যা ক্ষারকের সাথে প্রশমন বিক্রিয়া করে লবণ ও জল উৎপন্ন করে তাকে অম্ল বা অ্যাসিড (Acid) বলে।

ফরমিক এসিড বা মিথানোয়িক এসিড (H-COOH) :
পিঁপড়ার কামড়ের সময় পিঁপড়ার লালার সাথে মিথানয়িক এসিড নিঃসৃত হয় । তাই পিপড়ার কামড়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা হয় । পিঁপড়ার ল্যাটিন নাম ফরমিকা, তাই এই নামানুসারে এসিডটির ঐতিহাসিক নাম হল ফরমিক এসিড। বোলতা, মৌমাছি প্রভৃতির বিষেও ফরমিক এসিড থাকে। ফরমিক এসিডে অম্লীয় ও ক্ষারীয় গুণ আছে কোন এসিডে।

অ্যাসিটিক এসিড বা ইথানোয়িক এসিড (CH3-COOH) :
অনার্দ্র ও ১০০% বিশুদ্ধ অ্যাসিটিক এসিডকে শীতল করলে তা ১৭° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বরফের ন্যায় বর্ণহীন কেলাস গঠন করে; একে গ্লেসিয়াল অ্যাসিটিক এসিড বলে।

ভিনেগার (Vinegar):
অ্যাসিটিক এসিডের ৬ -১০% জলীয় দ্রবণকে ভিনেগার (Vinegar) বা সিরকা বলে। খাদ্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাছ ও মাংসের সংরক্ষণে সিরকা ব্যবহার করা যায় । শরীরের কোন জায়গায় কোন পোকা কামড় দিলে কামড়ের স্থানে আলতভাবে সিরকা লাগিয়ে দিলে ব্যথা সেরে যায়। রোদে দারুণভাবে পুড়ে যাওয়া ত্বকে সিরকা লাগালে ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরে আসে।

অক্সালিক এসিড (COOH)2 কচু ও ওল জাতীয় পদার্থের কান্ডে, মূলে ও পাতায় ক্যালসিয়াম অক্সালেট Ca(COO)2 এর কেলাস থাকে। খাওয়ার সময় এই কেলাস গলায় ফুটে গেলে গলা চুলকায়। ক্যালসিয়াম অক্সালেট জৈব অম্লে দ্রবণীয় এজন্য লেবু খেলে কুটকুট বন্ধ হয় ।

যেসব এসিডে কার্বক্সিলিক মূলক বা সালফোনিক এসিড মূলক থাকে তাদেরকে জৈব এসিড বলে। উপরোল্লিখিত এসিডগুলোর মধ্যে এসিটিক এসিড জৈব এসিড । কারণ এর মধ্যে কার্বক্সিলিক মূলক বিদ্যমান। এসিটিক এসিডের সংকেত CH3COOH ।

বিভিন্ন উপাদানে প্রাপ্ত এসিড
লেবুর রস সাইট্রিক এসিড
আমলকি অক্সালিক এসিড
আপেল, টমেটো ম্যালিক এসিড
তেতুল বা আঙ্গুর টারটারিক এসিড
কমলালেবু অ্যাসকরবিক এসিড
দুধ ল্যাকটিক এসিড
সিরকা এসিটিক এসিড

√ কাপড়ে কালির দাগ লাগলে যেভাবে উঠানো যায়: দাগের উপর লেবুর রস দিয়ে ঘষে।
√ ভিটামিন 'সি' এর রাসায়নিক নাম: অ্যাসকরবিক এসিড।

Shopping Cart
error: Content is protected !!
Scroll to Top