সলিনয়েডের ( তার কুন্ডলী ) ভেতর কোনো লোহার দন্ড ঢুকিয়ে তড়িৎপ্রবাহ চালনা করলে লোহার দন্ড চুম্বকে পরিণত হয় । একে তড়িৎ চুম্বক বলে। অর্থাৎ তড়িৎ প্রবাহের ফলে যে চুম্বকের সৃষ্টি হয় তাকে তড়িৎ চুম্বক বলে । তড়িৎ চুম্বক এক ধরনের অস্থায়ী চুম্বক । তড়িৎপ্রবাহ বন্ধ করলে এর চুম্বকত্ব থাকে না ।
তড়িৎ চুম্বকে মজ্জারূপে স্টীল ব্যবহার না করে কাঁচা লোহার দণ্ড ব্যবহার করা হয় কেন : কাঁচা লোহায় বেশ কয়েক পাকে জড়ানো অন্তরিক তামার তারের মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চালনা করলে কাঁচা লোহাটি অস্থায়ী চুম্বকে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে ষ্টীল ব্যবহার করে এর মধ্যে অন্তরিত তারের মাধ্যমে তড়িৎ প্রবাহ চালনা করলে ষ্টীলদণ্ডটি স্থায়ী চুম্বকে পরিণত হয় । এছাড়া কাঁচা লোহায় তড়িৎ প্রবাহ দ্বারা উৎপন্ন চুম্বকের শক্তি অপেক্ষাকৃত বেশি হয় । এজন্য তড়িৎ চুম্বকে মজ্জারূপে স্টীল ব্যবহার না করে কাঁচা লোহার দণ্ড ব্যবহার করা হয়।
তড়িৎ প্রবাহের চৌম্বক ক্রিয়া
কোনো পরিবাহীর ভেতর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহিত হলে এর আশেপাশে একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয় । একে তড়িৎ প্রবাহের চৌম্বক ক্রিয়া বলে।
ল্যাপ্লাসের সূত্র : ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের কোনো পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চলার ফলে এর আশেপাশে যে চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয় সে ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুর চৌম্বক প্রাবল্যের মান পরিবাহীর দৈর্ঘ্যের সমানুপাতিক, প্রবাহ মাত্রার সমানুপাতিক, পরিবাহীর মধ্য বিন্দু থেকে ঐ বিন্দুর দূরত্বে বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক, পরিবাহী এবং পরিবাহীর মধ্য বিন্দুর ও ঐ বিন্দুর সংযোজন সরলরেখার অন্তর্ভুক্ত কোণের সাইনের সমানুপাতিক ।
তড়িৎ চৌম্বক ক্ষেত্র
পরিবর্তনশীল চৌম্বকক্ষেত্র সবসময় বিদ্যুৎক্ষেত্র সৃষ্টি করে এবং এর বিপরীতক্রমে পরিবর্তনশীল বিদ্যুৎক্ষেত্র সবসময় চৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টি করে। বৈদ্যুতিক ও চৌম্বক বলসমূহের এ মিথস্ক্রিয়া সংশ্লিষ্ট স্থানে যে অবস্থা সৃষ্টি করে তা বিদ্যুৎ-চৌম্বক ক্ষেত্র নামে পরিচিত । বিদ্যুৎ চৌম্বকক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ ম্যাক্সওয়েল সমীকরণের সাহায্যে গাণিতিকভাবে প্রকাশ করা হয়।
অ্যাম্পিয়ারের সন্তরণ সূত্র: কোনো ব্যক্তি যদি তড়িৎবাহী তার বরাবর প্রবাহের অভিমুখে এমনভাবে সাঁতার কাটতে থাকেন যে তার মুখ সর্বদা চুম্বক শলাকার দিকে থাকে তাহলে তার বাম হাত যেদিকে প্রসারিত হয় চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু সেদিকে বিক্ষিপ্ত হবে অর্থাৎ ঐ দিকই হবে চৌম্বক ক্ষেত্রের বলরেখা তথা প্রাবল্যের অভিমুখ।
ম্যাক্সওয়েলের কর্ক-স্ক্রু সূত্র: একটি তড়িত্বাহী তার বরাবার প্রবাহের অভিমুখে একটি ডানপাকের কর্ক জুকে ঘুরালে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি যেদিকে ঘোরে চুম্বক শলাকার উত্তর মেরু সেদিকে বিক্ষিপ্ত হবে অর্থাৎ ঐ দিকই হবে চৌম্বক ক্ষেত্রের বলরেখা তথা প্রাবল্যের অভিমুখ ।
ফ্লেমিং-এর ডান হস্ত সূত্র: একটি তড়িৎবাহী তারকে প্রবাহের অভিমুখে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রসারিত করে ডান হাত দিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলে অন্য আঙ্গুলগুলোর মাথা চৌম্বক বলরেখার তথা প্রাবল্যের অভিমুখ নির্দেশ করে ।
তড়িৎ চুম্বকের প্রাবল্য বৃদ্ধি
তড়িৎবাহী সলিনয়েডের ভেতর কোনো লোহার দন্ড বা পেরেক ঢোকালে তা চুম্বকে পরিণত হয়। লোহার দন্ড বা পেরেক শুধু চুম্বকেই পরিণত হয় না, সলিনয়েডের নিজের যে চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে তাকেও শক্তিশালী করে । এর কারণ হলো, দন্ড বা পেরেকটি যখন তাড়িত চুম্বকে পরিণত হয় তখন এটি তার নিজের চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে। ফলে সলিনয়েডের চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া যায়। তড়িৎ প্রবাহ চলাকালীন সময়ে এটি বেশ শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয়। তড়িৎ চুম্বকের প্রাবল্য নিম্নোক্তভাবে ও পেরেকের চৌম্বক ক্ষেত্র মিলে সলিনয়েড থেকে বেশি চৌম্বকক্ষেত্র বাড়ানো যায় যেমন-
১. সলিনয়েডের তারের ভেতর দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ বাড়িয়ে,
২. সলিনয়েডের পাক বা প্যাচের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং
৩. লোহা দন্ড বা পেরেককে U অক্ষরের মতো বাঁকিয়ে মেরু দুটিকে আরো কাছাকাছি এনে।
কোনো তার দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ চালালে চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়: ওয়েরস্টেড ১৮২০ সালে আবিষ্কার করেন যে, তড়িৎবাহী তারের সাথে চৌম্বকক্ষেত্র বিজড়িত। কোনো সোজা খাড়া তারের দরুন চৌম্বক ক্ষেত্র রেখা বা বলরেখাগুলো হলো তারটিকে ঘিরে কতগুলো সমকেন্দ্রিক বৃত্ত। এ বৃত্তগুলো সমতল তারের সাথে লম্ব। তারের কাছাকাছি চৌম্বকক্ষেত্রের প্রাবল্য বেশি। তার থেকে দূরে যেতে থাকলে চৌম্বকক্ষেত্রের প্রাবল্য কমতে থাকে । এ চৌম্বক ক্ষেত্রের অভিমুখ ডানহাতি নিয়মে বের করা যায় । বৃদ্ধাঙ্গুলি খাড়া রেখে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করলে বৃদ্ধাঙ্গুলি যদি তড়িৎ প্রবাহের অভিমুখ নির্দেশ করে তাহলে অন্য আঙ্গুলি দিয়ে চুম্বকক্ষেত্রের অভিমুখ নির্দেশিত হবে ।
চৌম্বকক্ষেত্রের বলরেখাগুলো ঘড়ির কাঁটার দিকাভিমুখে যায় । তড়িৎ প্রবাহের দিক পরিবর্তন করলে ক্ষেত্রের অভিমুখও বিপরীতমুখী হয়ে যায়। কিন্তু ক্ষেত্র-প্যাটার্ন বা বিন্যাস একই থাকে। তারটিকে কুন্ডলী পাকিয়ে সলিনয়েড তৈরি করে চৌম্বকক্ষেত্রের প্রাবল্য বাড়ানো যায় ।
সলিনয়েড কি
সলিনয়েড হলো কাছাকাছি বা ঘন সন্নিবিষ্ট অনেকগুলো প্যাচযুক্ত লম্বা বেলনাকার কয়েল বা তার কুন্ডলী । একটি লম্বা অন্তরীত পরিবাহক তারকে স্প্রিংয়ের মতো বহুপাকে ঘন সন্নিবিষ্ট করে সাজালে বা কয়েল তৈরি করলে সলিনয়েড তৈরি হয়। অন্তরীত বেলনাকার চোঙের ওপর তার পেঁচিয়ে সলিনয়েড তৈরি করা যেতে পারে। তারের প্রতিটি পাক বেলনের অক্ষের সাথে লম্বভাবে থাকে ।
তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ
একটি গতিশীল চুম্বক বা তড়িৎবাহী বর্তনীর সাহায্যে অথবা একটি স্থির তড়িৎবাহী বর্তনীর তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ কম বেশি করে অন্য একটি সংবদ্ধ বর্তনীতে ক্ষনস্থায়ী তড়িচ্চালক বল ও তড়িৎ প্রবাহ উৎপন্ন হওয়ার পদ্ধতিকে তাড়িত চুম্বক আবেশ বলে।
তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ দু প্রকার । যথা :
[ক] স্বকীয় আবেশ (Self induction) ও
[খ] পারস্পরিক আবেশ (Mutual induction)
[ক ] স্বকীয় আবেশ: একটি মাত্র বদ্ধ কুন্ডলীতে অসম বিদ্যুৎ প্রবাহের দরুন চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তনের ফলে অথবা কোনো চৌম্বক ক্ষেত্রে বদ্ধ কুন্ডলীর গতির ফলে যে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় আবেশ ঘটে তাকে স্বকীয় আবেশ বলে ।
[খ] পারস্পরিক আবেশ : মুখ্য বর্তনীতে অসম বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে গৌণ কুন্ডলীতে যে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় আবেশ ঘটে, তাকে পারস্পরিক আবেশ বলে । সাধারণভাবে বলা যায়, এক কুন্ডলীতে অসম বিদ্যুৎ প্রবাহে সৃষ্ট চৌম্বক ফ্লাক্সের পরিবর্তনের ফলে যদি অপর বদ্ধ কুন্ডলীতে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় আবেশ ঘটে তবে ঐ আবেশই পারস্পরিক আবেশ।
তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ সংক্রান্ত ফ্যারাডের সূত্র
ফ্যারাডের তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশের সূত্রাবলী: ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্যারাডে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় আবেশের চারটি সূত্র আবিষ্কার করেন। তার নামানুসারে এদেরকে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় আবেশের ক্ষেত্রে ফ্যারাডের সূত্র বলে। সূত্রগুলো নিচে বিবৃত হলো :
প্রথম সূত্র: যখনই কোনো বদ্ধ তার কুন্ডলীতে আবদ্ধ চৌম্বক বলরেখার সংখ্যা বা চৌম্বক ফ্লাক্স- এর পরিবর্তন ঘটে তখনই উক্ত কুন্ডলীতে একটি বিদ্যুৎ চালক শক্তি আবিষ্ট হয়।
দ্বিতীয় সূত্র: তার কুন্ডলীতে আবিষ্ট বিদ্যুৎ চালক শক্তির মান সময়ের সাথে কুন্ডলী দিয়ে অতিক্রান্ত চৌম্বক বলরেখার সংখ্যা বা চৌম্বক ফ্লাক্স-এর পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক।
তৃতীয় সূত্র: তার কুন্ডলীতে আবদ্ধ চৌম্বক ফ্লাক্স-এর বাড়তি বিপরীত বিদ্যুৎ চালক শক্তি এবং ফ্লাক্স-এর ঘাটতি সমমুখী বিদ্যুৎ চালক শক্তি উৎপন্ন করে।
চতুর্থ সূত্র: তার কুন্ডলীতে আবিষ্ট বিদ্যুৎ চালক বলের মান গৌণ কুন্ডলীর পাক সংখ্যার সমানুপাতিক ।
মাইকেল ফ্যারাডের উল্লেখযোগ্য অবদান: ইলেক্ট্রোলাইসিসের সূত্র।