দিল্লী সালতানাত

দিল্লী সালতানাত বলতে মধ্যযুগে ১২০৬ থেকে ১৫২৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনকালকে বুঝানো হয়। এ সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শাসকগোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশ শাসন করলে ও তারা সকলেই ছিলেন মুসলিম । এই সময় বিভিন্ন তুর্কি ও আফগান রাজবংশ দিল্লি শাসন করে যেমন- মামলুক সুলতান বা দাস বংশ (১২০৬-৯০) , খিলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০), তুঘলক রাজবংশ (১৩২০-১৪১৩), সৈয়দ রাজবংশ (১৪১৩-৫১) এবং লোদি রাজবংশ (১৪৫১-১৫২৬)। এ সকল রাজবংশ ও সাম্রাজ্যকে একত্রে “দিল্লী সালতানাত” নামে অভিহিত করা হয় । দিল্লির সুলতানদের শাসনকালে ভারতীয় সভ্যতার সাথে ইসলামী সভ্যতার মিশ্রণ ঘটেছিল । দিল্লী সালতানাতের কারণেই ভারত উপমহাদেশ ইসলাম প্রচারের সুযোগ তৈরি হয়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে উপমহাদেশে ইসলাম একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় । ১৫২৬ সালে দিল্লি সালতানাত মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হলে উপমহাদেশে দিল্লী সালতানাতের অবসান হয় ।

দাস বংশ (১২০৬-৯০)

ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন মুহম্মদ ঘুরী। ময়েজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম ইতিহাসে মুহম্মদ ঘুরী নামে পরিচিত। কোন কোন ঐতিহাসিক ঘুরীদের পারসিক জাতি বলে অভিহিত করলেও ঐতিহাসিক লেনপুল তাদের আফগান জাতির বংশধর বলে অভিহিত করেছেন। গজনীতে ঘুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে মুহম্মদ ঘুরী উপমহাদেশে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।

  • তরাইনের প্রথম যুদ্ধ:
    • প্রতিপক্ষ : মুহম্মদ ঘুরী ও পৃথ্বিরাজ চৌহান
    • সময়কাল : ১১৯১ খ্রিঃ
    • ফলাফল : মুহম্মদ ঘুরী শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও আহত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
  • তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ:
    • প্রতিপক্ষ : মুহম্মদ ঘুরী ও পৃথ্বিরাজ চৌহান
    • সময়কাল : ১১৯২ খ্রিঃ
    • ফলাফল : পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত ও নিহত হন এবং মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

অতঃপর মুহম্মদ ঘুরী উত্তর উপমহাদেশের শাসনভার তার সুযোগ্য সেনাপতি কুতুবুদ্দিনের উপর ন্যস্ত করে গজনী প্রত্যাবর্তন করেন। কুতুবউদ্দিন উত্তর ভারতে রাজ্যবিস্তার করে দিল্লীতে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। 'আইবেক' কথাটির অর্থ হল 'ক্রীতদাস'। মুহাম্মদ ঘুরি কুতুবউদ্দিন আইবেককে ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয় করেছিলেন। এই কারণে ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশকে দাসবংশ নামে এবং ১২০৬ থেকে ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়কে মামলুকদের শাসনকাল হিসেবে অভিহিত করেন।

সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক (১২০৬-১২১০ সাল)

কুতুবুদ্দিন আইবেক মুহম্মদ ঘুরীর একজন ক্রীতদাস হিসাবে জীবন শুরু করেন। তিনি মুহম্মদ ঘুরির অনুমতিক্রমে ভারত বিজয়ের পর দিল্লীতে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেন। উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আইবেক। দানশীলতার জন্য তাঁকে ' লাখবক্স ' বলা হত। দিল্লীর কুতুবমিনার নামক সুউচ্চ মিনারটির নির্মাণকাজ শুরু হয় তাঁর শাসনামলে। তিনি মিনারটির নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেননি। দিল্লীর বিখ্যাত সাধক কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারে এর নাম রাখা হয় কুতুবমিনার।

সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুতমিশ (১২১১-১২৩৬ সাল)

কুতুবউদ্দিন আইবেকের জামাতা ইলতুৎমিশ ১২১১ সালে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি কুতুব মিনার নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করতে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন এবং নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। ভারতে মুসলমান শাসকদের মধ্যে তিনি প্রথম মুদ্রা প্রচলন করেন। তিনি ১২২৯ সালে বাগদাদের খলিফা আল মুনতাসির কর্তৃক 'সুলতান-ই-আজম' উপাধি প্রাপ্ত হন। তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বাংলার বিদ্রোহী সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওয়াজ খলজীকে পরাজিত করে বাংলা দিল্লীর শাসনাধীনে আনায়ন করেন। ইলতুৎমিশ চল্লিশজন দূর্বী সেনাপতির নেতৃত্বে এক বিরাট তুর্কী বাহিনী গঠন করেন। ইলতুতমিশের এ চল্লিশজন সেনাপতি ইতিহাসে বিশিষ্ট 'চল্লিশ' নামে পরিচিত।

সুলতানা রাজিয়া ( ১২৩৬ - ১২৪০ )

সুলতানা রাজিয়া ছিলেন ইলতুৎমিশের কন্যা। তিনি ছিলেন দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণকারী প্রথম মুসলমান নারী । ১২৩৬ সালে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অমাত্যদের চক্রান্তে মাত্র চার বছর পরই ১২৪০ সালে তিনি সিংহাসনচ্যুত হন।

সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ (১২৪৬-১২৬৬ সাল)

নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ছিলেন দিল্লির মামলুক সালতানাতের ৮ম সুলতান। তিনি নাসিরউদ্দিন মাহমুদের পুত্র ও সুলতান ইলতুতমিশের পৌত্র ছিলেন। ইলতুতমিশ তাকে তার বাবার নাম প্রদান করেছিলেন। আলাউদ্দিন মাসুদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি মসনদে বসেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মভীরু লোক ছিলেন । সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য তিনি ফকির বাদশাহ নামে পরিচিত। তিনি কুরআন নকল ও টুপি সিলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ সাল)

গিয়াসউদ্দিন বলবন ছিলেন দিল্লির ৯ম মামলুক সুলতান। তিনি প্রথমে নাসিরউদ্দিন মাহমুদের উজির ছিলেন। নাসিরউদ্দিন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়ার পর বলবন মসনদে বসেন। বলবন ১২৬৬ থেকে ১২৮৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত শাসন করেছেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বিদ্যোৎসাহী ও গুণীজনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। 'ভারতের তোতা পাখি' নামে পরিচিত আমীর খসরু বলবনের দরবার অলংকৃত করেন।

খলজী বংশ (১২৯০-১৩২০খ্রিঃ)

খলজী রাজবংশ ছিল তুর্কি-আফগান বংশোদ্ভুত মুসলিম রাজবংশ। ১২৯০ থেকে ১৩২০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই রাজবংশ দক্ষিণ এশিয়ার বিরাট অংশ শাসন করে। জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজী এই রাজবংশের পত্তন করেন। এটি দিল্লি সালতানাত শাসনকারী দ্বিতীয় রাজবংশ।

জালাল উদ্দিন খিলজী ( ১২৯০ - ১২৯৬ )

জালালউদ্দিন খিলজী যিনি সিংহাসন আরোহণের সময় ৭০ বছর বয়সি ছিলেন , একজন প্রজাদরদি এবং বিনয়ী সুলতান ছিলেন । তিনি খলজী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা । তুর্কি অভিজাতদের বিরুদ্ধাচরণ সত্বেও তিনি ১২৯০ সালে দিল্লির মসনদে বসেন। জালাল উদ্দিনের এই আরোহণ সবাই মেনে নেই নি। বরং তার ৬ বছরের শাসনে বলবন এর ভাইপো মমলুকদের প্রতি অনুগত সামরিক অধিনায়কদের নিয়ে বিদ্রোহ করে । জালাল উদ্দিন এই বিদ্রোহ দমান এবং অনেক অধিনায়কদের মৃত্যুদণ্ড দেন।

আলাউদ্দিন খলজী (১২৯৬-১৩১৬)

পর্যটক ইবনে বতুতা আলাউদ্দিন খলজীকে দিল্লীর শ্রেষ্ঠ সুলতান বলে অভিহিত করেছেন। আলাউদ্দিন খলজী জণগনের সার্বিক কল্যাণের জন্য দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের উপর হস্তক্ষেপ করেন এবং প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য নির্দিষ্ট হারে বেধে দেন। তিনি শিল্পানুরাগী ছিলেন। বিখ্যাত ' আলাই দরওয়াজা ' তাঁরই কীর্তি। তিনি প্রথম মুসলমান শাসক হিসাবে দক্ষিণ ভারত জয় করেন।

তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৩ সাল)

তুঘলক বংশ ১৩২০ সালে গিয়াসউদ্দিন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি তুর্কি মুসলিম রাজবংশ যারা ১৩২০ থেকে ১৪১৩ পর্যন্ত দিল্লী সালতানাতের শাসক ছিল। এই সালতানাতের রাজধানী ছিল দিল্লি। এই সাম্রাজ্য মধ্যযুগে ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেছে।

মুহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১)

  • মুহম্মদ বিন তুঘলক অত্যন্ত প্রতিভাশালী শাসক ছিলেন ।
  • দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর: রাজ্য শাসনের প্রত্যক্ষ অসুবিধা দূর করার জন্য ১৩২৬- ২৭ খ্রিস্টাব্দে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী দিল্লী থেকে দেবগিরিতে স্থানান্তর করেন। কিন্তু নানাকারণে কর্মচারীদের দেবগিরি পছন্দ না হওয়ায় এবং উত্তর ভারতে মোঙ্গলদের আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তিনি রাজধানী দিল্লীতে ফেরত আনেন।
  • প্রতীক মুদ্রার প্রচলন: সুলতান সোনা ও রূপার মুদ্রার পরিবর্তে প্রতীক তামার মুদ্রা প্রচলন করে মুদ্রামান নির্ধারণ করে দেন। প্রতীক মুদ্রা জাল না হওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন তা সে যুগে ছিল না। ফলে ব্যাপকভাবে মুদ্রা জাল হতে থাকে। এজন্য সুলতানকে এ পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হয়।
  • ইবনে বতুতার আগমন: ১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে ইবনে বতুতা ভারত বর্ষে আগমন করেন।

মাহমুদ শাহ

তুঘলক বংশের শেষ সুলতান ছিলেন মাহমুদ শাহ। বিখ্যাত তুর্কি বীর তৈমুর ছিলেন মধ্য এশিয়ার সমরকন্দের অধিপতি। শৈশবে তাঁর একটি পা খোড়া হয়ে যায় বলে তিনি তৈমুর লঙ নামে অভিহিত। মধ্য এশিয়ায় বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে ১৩৯৮ সালে তৈমুর ভারত আক্রমণ করেন। তৈমুরকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা মাহমুদ শাহের ছিলনা। তিনি বিনা বাধায় দিল্লীতে প্রবেশ করেন। প্রায় তিনমাস ধরে অবাধ হত্যা ও লুন্ঠনের পর তিনি বিপুল সম্পদ নিয়ে স্বদেশে ফিরে যান।

খান জাহান আলী

খানজাহান আলী ছিলেন একজন মুসলিম ধর্মপ্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের একজন স্থানীয় শাসক। খান জাহান আলী তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনাপতির পদে যোগদান করেন। তিনি রাজা গণেশকে রাজি করে বাংলার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন। তিনি বাগেরহাট জেলায় বিখ্যাত ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীতে (১৪৩৫-১৪৫৯ খ্রিঃ) এটি নির্মাণ করেন।

মসজিদের নাম ষাট গম্বুজ হলেও মসজিদে গম্বুজ মোটেও ষাটটি নয়, গম্বুজ মোট ৮১টি। মসজিদের ভিতরে ষাটটি স্তম্ভ বা পিলার আছে। মসজিদের চারকোণায় চারটি মিনার আছে। এটি বাংলাদেশের মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় মসজিদ। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে।

লোদী বংশ (১৪৫১-১৫২৬ খ্রিঃ)

লোদী রাজবংশটি পশতুন (আফগান) লোদী উপজাতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাহলুল খান লোদী ,লোদী রাজবংশের সূচনা করেছিলেন এবং প্রথম পশতুন ছিলেন যিনি দিল্লির সুলতানি শাসন করেছিলেন। লোদী বংশ রাজবংশ দিল্লী সালতানাতের পঞ্চম এবং সর্বশেষ রাজবংশ । ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের নিকট দিল্লীর লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদীর পরাজয়ের মাধ্যমে দিল্লীর সালতানাতের পতন ঘটে। ১৫২৬ সালে বাবর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপনে উদ্যোগী হলে দিল্লীর সুলতানি শাসনের অবসান ঘটে।

Shopping Cart
error: Content is protected !!
Scroll to Top