বাংলা ভাষা যেমন বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে, তেমনি বাংলা লিপি ও নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। লিপি হচ্ছে লিখন পদ্ধতি। পৃথিবীর প্রায় সকল লিপিই ফিনিশিয় লিপি থেকে উদ্ভব হয়েছে। প্রাচীন ভারতের প্রচলিত চিত্রলিপি থেকে ভারতীয় লিপির উৎপত্তি ঘটে। এ ভারতীয় লিপির রূপ দুইটি। যথা: ১. ব্রাহ্মী লিপি, ২. খরোষ্ঠী লিপি। এ ব্রাহ্মী লিপির কুটিল রূপ পূর্বী লিপি থেকে বাংলা লিপির উৎপত্তি। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশনে প্রেস স্থাপিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়ে হাতে লেখা হয়েছে বলে বাংলা লিপি নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে। ছাপাখানার প্রভাবে বাংলা লিপি স্থায়ী রূপ লাভ করে এবং পরবর্তীকালে বাংলা লিপির আর তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
বাংলা লিপি
ধ্বনির লিখিত রূপই লিপি বা Script । বাংলা ভাষা লিখে প্রকাশ করার জন্য যে লিপি বা Script ব্যবহার করা হয় তাকে বাংলা লিপি বলা হয়।
বাংলা লিপি বা বর্ণ মোট ৫০ টি।
বাংলা লিপি দু ধরনের যথা: স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জণবর্ণ।
স্বরবর্ণ ১১ টি এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৯ টি।
স্বরবর্ণের আবার সংক্ষিপ্ত রুপ রয়েছে যাদের কার চিহ্ন বলা হয়। কার চিহ্ন মোট ১০ টি।
বাংলা লিপি মুদ্রণের ইতিহাস
১৭৭৮ সালে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের (হালেদ) এর হাত ধরে ”আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ” প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলা মুদ্রণশিল্পের জন্ম হয়। যদি ও বইটি ইংরেজিতে ছিল কিন্তু বাংলা বর্ণ পরিচয় সংক্রান্ত কিছুই বাংলাতে লিখা হয়েছিল। এই মুদ্রণে প্রথমবারের মত "বিচল হরফ" প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
তবে এই প্রথম দিককার হরফগুলি খুব সুদৃশ্য ও পরিণত ছিল না। ইংরেজির তুলনায় বাংলা হরফের আকার ছিল বেশ বড়। ইউরোপে এর প্রায় তিনশত বছর আগেই বিচল হরফে ছাপার প্রযুক্তি শুরু হয়ে গেলেও বাংলাতে এটি ছিল একেবারেই নতুন একটি ঘটনা। ১৮০০ সালে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে পঞ্চানন কর্মকারের সাথে উইলিয়াম কেরি ও উইলিয়াম ওয়ার্ড ছিলেন। এদের মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলা হরফের চেহারার উন্নতি হতে থাকে।
বাংলা লিপির উৎপত্তি
বাংলা লিপির উৎপত্তি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে- সপ্তম শতাব্দী এবং ড. সুনীতিকুমারের মতে- দশম শতাব্দীতে। প্রাচীন ভারতের প্রচলিত চিত্রলিপি থেকে ভারতীয় লিপির উৎপত্তি। ভারতীয় লিপির রূপ আবার দুইটি।
যথা: ১. ব্রাহ্মী লিপি ২. খরোষ্ঠী লিপি ।
ভারতের মৌলিক লিপি হচ্ছে ব্রাহ্মী লিপি। সকল ভারতীয় লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে জন্মলাভ করেছে। বাংলা, সিংহলী, ব্রহ্মী, শ্যামী, যবদ্বীপ ও তিব্বতী লিপির উৎসও ব্রাহ্মী লিপি। ব্রাহ্মী লিপি বাম দিক থেকে লেখা হয় এবং খরোষ্ঠী লিপি ডানদিক থেকে লেখা শুরু হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে আর্য ভাষার প্রাচীনতম যে বর্ণমালার সন্ধান পাওয়া যায় তা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের, অশোকের অনুশাসনামলের। বগুড়ার মহাস্থানগড়ে যে লিপি পাওয়া গেছে, তা উভয় প্রাপ্ত লিপির সাথে সাদৃশ্য আছে। এই লিপিকে ব্রাহ্মী লিপি বলে। ব্রাহ্মী লিপি কুষাণ ও গুপ্ত রাজাদের আমলে পরিবর্তিত হয়ে তিনটি রূপ ধারণ করে । যথা:
ক. সারদা (কাশ্মির ও পাঞ্জাবে প্রচলিত রূপ)
খ. নাগর (রাজস্থান, মালব, গুজরাট ও মধ্যপ্রদেশে প্রচলিত রূপ)
গ. কুটিল (ভারতের পূর্বাঞ্চলে প্রচলিত রূপ)।
বাংলা লিপির উৎপত্তি ব্রাহ্মী লিপির কুটিল রূপ ‘পূর্বী লিপি’থেকে। সম্রাট অশোক তাঁর অধিকাংশ কর্ম ব্রাহ্মী লিপিতে লেখান। পাল শাসন আমলে বাংলা লিপির প্রসার ঘটে ও সেন আমলে এর গঠন কাজ শুরু হয় এবং পাঠান যুগে এটি সাময়িক স্থায়িত্ব লাভ করে।
বাংলা লিপির অক্ষর স্থায়িত্ব লাভ করে ১৮০০ সালে শ্রীরামপুর মিশনে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে। বাংলা লিপির অক্ষর বা বর্ণের আধুনিক রূপ দেন পঞ্চানন কর্মকার। নিচে বাংলা লিপির উৎপত্তির একটি ধারাবাহিক চিত্র সংযোজন করা হল।