দেশের ১২টি ক্যাডেট কলেজ শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মানসম্মত শিক্ষার পাশাপাশি ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম, বাধ্যতামূলক শারীরিক প্রশিক্ষণের (পিটি) মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে এসব প্রতিষ্ঠান। এখানকার শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে হয় না কিংবা প্রাইভেট পড়তে হয় না।
সার্বক্ষণিক ব্যক্তিগত ও দলগত প্রতিযোগিতায় মূল্যায়ন করা হয় শিক্ষার্থীদের। নিরাপত্তাগত দুশ্চিন্তাও নেই অভিভাবকদের। এসব কারণে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে শিক্ষার্থীদের ভিড় দিন দিন বাড়ছে। চলতি বছর ৬শ’ আসনের বিপরীতে ২২ থেকে ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় দু’হাজার বেশি। প্রতিটি আসনের বিপরীতে প্রায় ৩৭ জন অংশ নেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাডেট কলেজগুলোর গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ও সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল (এজি) মেজর জেনারেল এসএম মতিউর রহমান বলেন, ‘ক্যাডেট কলেজের একজন শিক্ষার্থীকে আচরণ ও শৃংখলা থেকে শুরু করে সামগ্রিকভাবে লেখাপড়ার গভীরে পৌঁছানোই আমাদের উদ্দেশ্য। আমরা সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষায় বিশ্বাস করি না। শুধু কিছু প্রশ্ন দিয়ে দিলাম, উত্তরপত্র তৈরি করে পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেল; কিন্তু শিক্ষার্থী পরে ভর্তি পরীক্ষায় (বিশ্ববিদ্যালয়) অন্যদের সঙ্গে টিকতে পারল না, কোনো মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারল না- তাহলে সেই জিপিএ-৫ তো মূল্যহীন।
’বিদ্যমান ক্যাডেট কলেজের মধ্যে ৯টিতে ছেলেরা এবং ৩টিতে মেয়েরা লেখাপড়া করে থাকে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের সবচেয়ে পুরনো ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ এবং ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ সরেজমিন পরিদর্শনের ব্যবস্থা করে। পরিদর্শনে গিয়ে ক্যাডেট কলেজের সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। ছাত্রছাত্রীরা অত্যন্ত শৃংখলা ও অধ্যবসায়ের মধ্যে ক্লাস কার্যক্রম, ব্যক্তিগত অধ্যয়ন, খেলাধুলা, পিটি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে বড় হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য কলেজের ভেতরেই আছে সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা জানায়, সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১০টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে ক্যাডেটরা। সপ্তাহে ৪ দিন পিটি ও ২ দিন ড্রিল করার মধ্যদিয়ে শুরু হয় দিনের। সাড়ে ৭টায় নাস্তা খেয়ে ৮টার মধ্যে ক্লাসে যেতে হয়। সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ক্লাসে আলোচনা চলে কারও কোনো পড়া বুঝতে সমস্যা আছে কিনা। সাড়ে ৮টা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে মিল্ক ব্রেকসহ (দুধসহ হাল্কা নাস্তা) চলে দেড়টা পর্যন্ত। ১টা ৪০ মিনিটে ডাইনিং হলে দুপুরের খাবার খেতে হয়। সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নিজের আবাসিক হাউসে ফিরে বিশ্রাম নেয় ছাত্ররা। সাড়ে ৩টার পর কলেজ মাঠে বাস্কেটবল, ভলিবল, সাঁতার, স্কোয়াশ, ফুটবল যে কোনো একটি খেলা বাধ্যতামূলক।
সন্ধ্যার নাস্তা খেয়ে মুসলমান ক্যাডেটরা মাগরিবের নামাজ পড়তে কলেজের মসজিদে যায়। অন্য ধর্মের ছাত্ররা নিজ নিজ হাউসের প্রার্থনা রুমে প্রার্থনা করে। ক্যাডেট কলেজে সান্ধ্যপ্রার্থনাকে ‘ডিসিপ্লিনের অংশ’ হিসেবে ধরা হয়। এরপর সাড়ে ৬টায় শুরু ব্যক্তিগত অধ্যয়ন। রাত ৮টায় আবার ডাইনিং হলে সবাই একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে পড়ার টেবিলে ফিরে যায়। চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। ১০টায় যার যার হাউসে ফিরে যায় সবাই। এই সময়টাতে প্রয়োজনে হল কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ক্যাডেটরা মোবাইল ফোনে বাসায় কথা বলতে পারে। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে একসঙ্গে নিভে যায় সব হাউসের বাতি। তার আগে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব বা পরদিন পরিধানের জন্য জামা-কাপড়-জুতো ঠিকঠাক করার সুযোগ দেয়া হয়।ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ কর্নেল মোহাম্মদ রকিবউদ্দিন খান বলেন, দেশের সব ক্যাডেট কলেজে একই ধরনের রুটিন অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এভাবে ক্যাডেট কলেজ সুশৃংখল জীবন ও শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিটি ক্যাডেটকে চৌকস ও নেতৃত্বসুলভ গুণাবলীর অধিকারী করে গড়ে তোলে।
১৯৫৮ সালে ১৮৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে চলাচলের সময়ে দূর থেকেই নজরে পড়ে ‘ডিডস নট ওয়ার্ড’ (কথা নয় কাজ) শীর্ষক কলেজের মোটো। ছাত্রদের জন্য চারটি হাউস আছে। আছে সর্বাধুনিক গবেষণাগার। পাঠ্যবইবহির্ভূত শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম দেয়ার লক্ষ্যে ইনফরমেশন রুম ও মিউজিয়াম। লাইব্রেরিতে আছে সৃজনশীল সাহিত্য পাঠের ব্যবস্থা। ক্যাফেটেরিয়া, কম্পিউটার ল্যাব, আর্ট গ্যালারি, হাসপাতাল, মসজিদ, জিমনেশিয়াম, ট্রেনিং গ্রাউন্ড, সুইমিংপুল, মেটাল ও উড ওয়ার্কশপসহ বিভিন্ন ধরনের খেলার মাঠও আছে। সৃজনশীলতা চর্চায় দেয়াল পত্রিকা বের হয় নিয়মিত।
অপরদিকে ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। ফেনী-ছাগলনাইয়া মহাসড়কের পাশে প্রায় সাড়ে ৪৭ একর জমির ওপর মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজের মোটো হচ্ছে, ‘নবেল এডুকেশন ডিসেন্ট লাইফ’ (মহৎ শিক্ষা উত্তম জীবন)। কলেজের অধ্যক্ষ জাহানা চৌধুরী বলেন, প্রত্যেক তরুণ ক্যাডেটকে সর্বগুণে গুণান্বিত করে পূর্ণাঙ্গ ক্যাডেট হিসেবে তৈরি করা হয় ক্যাডেট কলেজে। সব কলেজেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠ্যবই পড়ানো হয়ে থাকে। ক্যাডেট কলেজে গাইড বই এবং কোচিং কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের যেখানে সকাল থেকে রাত অবধি ক্লাস-কোচিং আর ব্যক্তিগত অধ্যয়নে ব্যস্ত থাকতে হয়, সেখানে কোচিং ছাড়াই মাত্র ৮ ঘণ্টার লেখাপড়ায় ক্যাডেটরা পরীক্ষায় এত ভালো ফল করছে কিভাবে এমন প্রশ্নের উত্তরে ফৌজদারহাট কলেজের শিক্ষক জুয়েল রানা কুতুব বলেন, সাধারণ স্কুল-কলেজে ক্লাসরুমে অনেক ছাত্রছাত্রী থাকে। এখানে প্রতিটি ক্লাসে সর্বোচ্চ ২৯ জন থাকে। ফলে শিক্ষক সবাইকে নিবিড়ভাবে পড়ানোর সুযোগ পান। কোনো ছাত্রের কোনো কিছু বুঝতে সমস্যা হলে ক্লাসের বাইরেও আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারছে।
একজন শিক্ষার্থী কেন ক্যাডেট কলেজে পড়তে আগ্রহী হবে- এমন প্রশ্নের উত্তরে ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্রী তাসফিয়া জামান বলে, ‘ক্লাসের পর যাতে কোনো শিক্ষার্থীকে আর পড়তে না হয় সেটা মাথায় রেখে শিক্ষক এখানে পাঠদান করান। আর বাইরে বেশিরভাগ শিক্ষক পড়ান শিক্ষার্থীকে যাতে তার কাছে কোচিংয়ে যেতে হয় তা মাথায় রেখে।’ দুটি কলেজ পরিদর্শনকালে জানা গেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের নির্দেশনায় এবং অধ্যক্ষের পরিচালনায় সব কলেজ পরিচালিত হয়। প্রতি ৮ ছাত্রের জন্য আছেন একজন শিক্ষক।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ক্যাডেট শিক্ষায় শিক্ষার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে মেজর জেনারেল এসএম মতিউর রহমান বলেন, প্রথমে আমরা লিখিত পরীক্ষা নিয়ে থাকি। পরে মেধা তালিকা দেখে মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রার্থী বাছাই করি। মৌখিক পরীক্ষা শেষে নির্বাচিত ক্যাডেটদের আইএসএসবিতে নিয়ে যাওয়া হয় মানসিক ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য। এরপর তারা ক্যাডেট কলেজগুলোয় ভর্তির সুযোগ পায়।
তিনি জানান, প্রতি বছর ১২টি কলেজে ৬০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়ে থাকে। ভর্তির ক্ষেত্রে মেধাই মূল বিবেচ্য বিষয়। কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কেউ কোটা সুবিধা পায় না। খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিভাবকদের আয়ের ওপর ভিত্তি করে এখানে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি ও থাকা-খাওয়ার খরচ ধার্য করা হয়। সরকারি চাকরিজীবীদের সর্বনিন্ম ১৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের সর্বনিন্ম ১৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক ফি দিতে হয় ক্যাডেট কলেজে।